ভারত কেন বাংলাদেশ, সেভেন সিস্টার্স ও পাকিস্তান নিয়ে উদ্বিগ্ন?
ভারত কেন বাংলাদেশ, সেভেন সিস্টার্স ও পাকিস্তান নিয়ে উদ্বিগ্ন?
গত দেড় দশকে ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্কের উন্নতির কথা শোনা গেলেও ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। যদিও অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক কিছুটা স্থিতিশীল, তবে ভিসা বন্ধ রয়েছে। জনসাধারণের স্তরে সম্পর্কের পরিস্থিতি অনেকটাই খারাপ হয়েছে। বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থানের পর সেভেন সিস্টার্স নিয়ে ভারতে উদ্বেগ ও উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। পাশাপাশি, বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্ক নিয়েও দিল্লি চিন্তিত।
ভারতের ওপি জিন্দাল গ্লোবাল ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক শ্রীরাধা দত্ত দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ নিয়ে গবেষণা করছেন। বিবিসিকে তিনি বলেন, অভ্যুত্থান-পরবর্তী সরকার ভারতের কাছে একটি 'এক্সপেরিমেন্টাল গর্ভনমেন্ট' হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এই কারণে আওয়ামী লীগের প্রস্থান ভারতের নিরাপত্তা উদ্বেগ বাড়াচ্ছে, যা ২০০১-০৬ সময়কালের খারাপ সম্পর্ক ও সহিংস কর্মকাণ্ডের স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়। ওই সময়ে বাংলাদেশ থেকে সন্ত্রাসী কার্যক্রম এবং বাইরের শক্তির প্রভাব ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকার পতনের পর অভ্যুত্থানকারী ছাত্রনেতা এবং বাংলাদেশের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিরা যেসব বার্তা ভারত পেয়েছে, তা নিয়ে তাদের মধ্যে কিছুটা অস্বস্তি রয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের আগে ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে ইনসার্জেন্টদের বেশ কয়েকটি ক্যাম্প তৈরি হয়েছিল, এ বিষয়ে শ্রীরাধা দত্ত উল্লেখ করেন, যা নিয়ে কিছুটা উদ্বেগের সৃষ্টি হতে পারে।
বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের সম্পর্কের গতিপ্রকৃতি ভারতীয় দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে, কারণ বর্তমান সরকারের সময়ে পাকিস্তান থেকে সরাসরি পণ্যবাহী জাহাজ বাংলাদেশে আসা শুরু করেছে। অধ্যাপক শ্রীরাধা দত্ত বলেন, পাকিস্তান বাংলাদেশে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার সুযোগ গ্রহণ করে ভারতবিরোধী কার্যক্রম চালানোর চেষ্টা করতে পারে। এছাড়া, পাকিস্তান থেকে অস্ত্র কেনার খবর এবং জিন্নাহর জন্মদিন উদযাপনও ভারতের উদ্বেগ বাড়িয়েছে।
বাংলাদেশে অভ্যুত্থানের পর ভারতীয় গণমাধ্যম এবং সামাজিক মাধ্যমে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ভিত্তিহীন তথ্য ও গুজব ছড়ানো হয়েছে। এ বিষয়ে শ্রীরাধা দত্ত বলেন, বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে এমন স্পষ্ট বার্তা পাওয়া যাচ্ছে না, আর সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া গুজব পরিস্থিতি আরও জটিল করছে। তিনি দুই দেশের মধ্যে ধর্মীয় উত্তেজনাকে অপ্রত্যাশিত আখ্যা দিয়ে সম্পর্ক সুন্দর রাখার আহ্বান জানান।
এদিকে, আগরতলায় বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশনে হামলার প্রতিবাদে ঢাকায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠন বিক্ষোভ মিছিল করেছে। জাতীয় নাগরিক কমিটির মিছিলে সদস্য সচিব আখতার হোসেন শেখ হাসিনাকে ভারতে আশ্রয় দেওয়ার সমালোচনা করেন এবং ভারত-বাংলাদেশ চুক্তি পুনর্মূল্যায়নের আহ্বান জানান। সীমান্ত হত্যা ও পানির ন্যায্য হিস্যার বিষয়ে নতজানু নীতির সমালোচনা করে প্রতিবাদ মিছিলে সামনের সারিতে অংশ নেওয়া তাজনুভা জাবিন বলেন, বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে শত্রুতা নয়, বরং সমমর্যাদার সম্পর্ক চায়। এছাড়া, ভারতে বাংলাদেশ নিয়ে প্রতিক্রিয়া বাড়াবাড়ি বলে দাবি করে ঢাকায় বিভিন্ন কূটনীতিক মিশন ও রাষ্ট্রদূতদের ব্রিফ করেছে বাংলাদেশ সরকার।
ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের এই টানাপোড়েনের সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিক হলো দুই দেশের জনগণের মধ্যে সম্পর্কের চরম অবনতি।
ভারতে বাংলাদেশ হাইকমিশনে কাজের অভিজ্ঞতা থেকে সাবেক কূটনীতিক এম হুমায়ুন কবির মনে করেন, দুই দেশের মানুষের মধ্যে সম্পর্কের এই নেতিবাচক অবস্থাটি নজিরবিহীন। তিনি বলেন, জনগণের পর্যায়ে সম্পর্কের যে উত্তেজনা দেখা যাচ্ছে, তারই প্রতিফলন হিসেবে ভারতে বাংলাদেশ মিশনে হামলা এবং বাংলাদেশজুড়ে প্রতিবাদ বিক্ষোভ ঘটছে।
এম হুমায়ুন কবির আরও বলেন, দুই দেশের মধ্যে এখন এক ধরনের উত্তেজনা দেখা যাচ্ছে, যা প্রধানত জনগণ পর্যায়ে। জনতার মধ্যে নতুন ধরনের উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে, যা আশঙ্কার কারণ। তিনি বলেন, এর ফলে ভারতে বাংলাদেশিদের হোটেলে থাকার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না, সীমান্তে ভারতীয়রা বিক্ষোভ প্রদর্শন করছে, বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করছে এবং পণ্যসামগ্রী আদান-প্রদানেও বাধা সৃষ্টি করার চেষ্টা হচ্ছে। এসবই তাকে উদ্বিগ্ন করছে।
বিবিসির সাথে আলাপকালে এম হুমায়ুন কবির বলেন, এখনকার পরিস্থিতি দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের জন্য নেতিবাচক বার্তা বহন করছে। তিনি বলেন, ভারত ভিসা বন্ধ করে দিয়েছে, যা সাধারণ মানুষের কাছে এমন বার্তা পৌঁছাচ্ছে যে ভারত বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির সাথে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত নয়। ভিসা বন্ধ রাখার মাধ্যমে মেসেজটি নেতিবাচকই রয়ে গেছে। অন্যান্য পরিষেবাগুলোর অভাবও নেতিবাচক বার্তা দিচ্ছে। তিনি উল্লেখ করেন, আগরতলাতে তাদের অফিসও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, যা আবারও নেতিবাচক বার্তা প্রকাশ করছে যে বাংলাদেশ ভারতের ভিসা দেবে না।
পর্যবেক্ষকরা জানান, ৫ আগস্টের পর ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে আলোচনার সুযোগ সীমিত হয়ে গেছে। এম হুমায়ুন কবির দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে আলাপ-আলোচনার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে বলেন, স্বাভাবিক অবস্থায় সরকারি, বেসরকারি এবং জনগণের পর্যায়ে যে ধরনের যোগাযোগ হয়, তা এখন স্থবির হয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, এসব যোগাযোগ পুনরায় চালু করা দরকার, তবে তবেই সম্পর্ক ধীরে ধীরে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরবে।
No comments